কারাগার যখন জাদুঘর
প্রকাশ: ২০১৬-১১-০৭ ১৪:৪২:৩০ || আপডেট: ২০১৬-১১-০৭ ১৪:৪২:৩০
নিউজ ডেস্ক: পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারটি এই বত্সর ২৯ জুলাই হইতে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই লইয়াছে। কিন্তু ইহার প্রতি ইঞ্চি জমিনে গাঁথিয়া আছে ২২৮ বত্সরের স্মৃতি। সেই ব্রিটিশ আমলের প্রারম্ভে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে নির্মিত হয় ক্রিমিনাল ওয়ার্ড, যাহা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নামে। চলতি বত্সর কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি স্থানান্তর হইবার পর গত ২ হইতে ৫ নভেম্বর প্রথমবারের জন্য সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য ইহা সাময়িকভাবে উন্মুক্ত করা হয় নামমাত্র প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে। স্থানটি ঐতিহাসিক, তাহার স্থানান্তর ঐতিহাসিক, এবং তাহা উন্মুক্ত করিয়া দেওয়ার প্রয়াসটিও ঐতিহাসিক। কারাগারটির অন্দরে কত নিযুত মানুষ অন্তরীণ ছিলেন, কত দেশপ্রেমিকের কত দুঃখগাথা, কত ভয়ানক অপরাধী ও অপরাধের কেচ্ছা, কত রাজনৈতিক উত্থান-পতন—এমন বিচিত্র সাক্ষ্যবহনকারী স্থান বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নাই বলা যায়।
সোয়া দুই শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিচ্ছাপ রহিয়াছে ইহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ইহার দেয়ালে দেয়ালে কত দীর্ঘশ্বাস, কত বিচিত্র মানুষের স্পর্শে ইহা উদ্ভাসিত, কত নোংরা হাতের ছোপে ইহা কলঙ্কিত। ইহা এক তুলনাহীন স্থান, চাহিলেই ইহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায় না, চাহিলেই ইহার ভেতর হইতে বাহির হওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমল হইতেই এই কারাগারে কেবল অপরাধীরাই বন্দী থাকে নাই, ইহাতে অন্তরীণ ছিলেন বহু বিপ্লবী, এই দেশের মুক্তি সংগ্রামের অনেক লড়াকু বীর। রাজনৈতিক জীবনে বহুবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেল খাটিয়াছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসমেত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তান আমল হইতে স্বাধীন বাংলাদেশেও জেল খাটিয়াছেন অনেক সংগ্রামী নেতা। জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইলে কয়েদিখানা খুলিয়া দেয় কারারক্ষীরা। কারারক্ষী ও কর্মকর্তারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ৭৮ দিনের ব্যবধানে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই। সুতরাং এইসকল ঐতিহাসিক ঘটনাবিজড়িত এই স্থানটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের জীবন্ত জাদুঘর হিসাবে গড়িয়া তোলাটাই যথার্থ। জানা যায়, সরকারের পরিকল্পনাও রহিয়াছে অতীত হইয়া উঠা এই কারাগারটিকে তদ্রূপ সজ্জিত করা। ইহার অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও জাতীয় চার নেতার জাদুঘর নির্মাণসহ ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করারও পরিকল্পনা রহিয়াছে সরকারের। এবং আরো কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে ইহাকে বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে গড়িয়া তোলা হইবে।
ইহা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাইবার যোগ্য। কারণ ইতিহাস আমাদের শেকড় চেনায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো ২২৮ বত্সরের পুরাতন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে আকীর্ণ যে বেদনার ইতিহাস—তাহাকে অতি নিকট হইতে দেখিবার মধ্যে যে শিহরণ, তাহা যত বেশি মানুষের মাঝে ছড়াইয়া দেওয়া যায় ততই উপলব্ধি করানো সহজ হয়—কী ধরনের বিবর্তনের মধ্যদিয়া আজকের রূপ অর্জন করিয়াছে এই বাংলাদেশ। ইহা কম কথা নহে।